Header Ads Widget

ফেসবুকে লাইক বাড়াতে ‘ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় চাওয়া’— ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান

ফেসবুকে লাইক বাড়াতে ‘ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় চাওয়া’— ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন, মূলধারার মিডিয়া ও সামাজিকমাধ্যমে গত কয়েক মাসে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই সরকারের নেতৃত্ব দেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে তার কার্যকালের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ‘ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় চাই’— এই স্লোগানটি সামাজিকমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই স্লোগান এখন রাজনীতির বাইরেও ফেসবুকে খাবার, প্রসাধনী, পোশাক কিংবা ব্যক্তিগত ভ্লগের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে শুধুমাত্র লাইক বা ফলো বাড়াতে।

বিজ্ঞাপনে রাজনৈতিক স্লোগান কিন্তু কোথাও ‘ডিসক্লেইমার’ নেই

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে সামাজিকমাধ্যমে ‘ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চাই’ স্লোগানটি ছড়িয়ে পড়ে। সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম একটি ফেসবুক পোস্টে স্লোগানটি ব্যবহার করেন। তাৎক্ষণিকভাবে এটিকে অবাস্তব ও অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়– কিছু ফেসবুক পেজ এই জনমতের সুযোগ নিয়ে নিজেদের পেজে এমন বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করে।


সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত ৪৭টি ফেসবুক পেজ ৫৫টি বিজ্ঞাপন চালিয়েছে। বাংলা কীওয়ার্ড যেমন ‘ইউনূস’, ‘ইউনুস’ (বিকল্প বানান), ও ‘৫ বছর’ ব্যবহার করে মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে এসব বিজ্ঞাপন শনাক্ত করা হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, এসব পেজের ৯০ শতাংশ আগে কোনো রাজনৈতিক কনটেন্ট প্রকাশ করেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহার করতে শুরু করে। মেটার নীতিমালা অনুযায়ী, সামাজিক ইস্যু বা রাজনৈতিক বক্তব্যে স্পষ্ট ‘পেইড ফর বাই’ ডিসক্লেইমার থাকা বাধ্যতামূলক, যা কোনো বিজ্ঞাপনেই ছিল না।

খাবার ও ভ্লগ পেজে ড. ইউনূসের নাম

১৩ ও ১৪ মে দুটি বিজ্ঞাপন চালায় ঢাকাভিত্তিক ‘দ্য টেস্টি অ্যাপ্রন’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট পেজ। একটি বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল– ‘আপনি যদি চান ড. ইউনূস পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক, তাহলে ডান পাশে লাইক অপশনে ক্লিক করুন।’ অথচ তাদের অন্য কোনো পোস্টে রাজনীতির উপস্থিতি নেই।

‘ন্যাচারাল হেলথ বিডি’ নামের একটি পেজ ‘হেলথ প্লাস ট্যাবলেট’ নামে একটি পণ্য বিক্রি করে, রাজনীতির সঙ্গে যে পেজের কোনো সম্পর্ক নেই। আবার ‘আমবাজার’ নামের একটি পেজ ৮ মে খোলা হয়েছে, যারা নিয়মিত আম বিক্রির পোস্ট দেয়। তারাও ১৫ মে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন দেয়।

লাইকের জন্য রাজনীতি: কৌশলগত অপব্যবহার

এই ৪৭টি ফেসবুক পেজের গড়ে প্রতি পেজে ৩৫ হাজার লাইক এবং ৩৭ হাজার ফলোয়ার ছিল। সবচেয়ে বেশি ফলোয়ার ছিল ‘খবর২৪’ নামের একটি সংবাদ পেজে (প্রায় ৩ লাখ ৪৩ হাজার)। সবচেয়ে কম ফলোয়ার ছিল ‘প্রিমিয়াম বিডি’ পেজে, মাত্র ১১ জন।

এদের মধ্যে ৩০টি পেজ ছিল ব্যবসা সংশ্লিষ্ট, আটটি ছিল ব্যক্তিগত ভ্লগ, দুটি মিডিয়া পেজ, আর বাকিগুলো ‘পাবলিক ফিগার’ ও ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। ২৬টি পেজের অ্যাডমিনদের অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা যায়– ২৪টি বাংলাদেশ থেকে, একটি ইতালি থেকে এবং একটি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে পরিচালিত।

বিজ্ঞাপনদাতারা বলছেন—তারা জানতেনই না, বিষয়বস্তু কী

ডিসমিসল্যাব ছয়জন পেজ অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলে। তাদের মধ্যে চারজন জানান, তারা নিজে বিজ্ঞাপন তৈরি করেননি বরং বিজ্ঞাপন এজেন্সিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একজন স্বীকার করেন, লাইক-ফলো বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নিজেই বিজ্ঞাপন তৈরি করেছেন।

একজন অ্যাডমিন বলেন, ‘আমরা শুধু বলেছিলাম, ফলোয়ার বাড়াতে হবে। কেমন বিজ্ঞাপন চলবে, সেটা পুরোপুরি এজেন্সির সিদ্ধান্ত।’

এ প্রসঙ্গে মার্কেটিং এজেন্সি ‘ইয়াতি ডিজিটাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা এ এম ফারুক বলেন, ‘এ ধরনের বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্যই থাকে ফলোয়ার বাড়ানো। এখন পেজের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করা হয় ফলোয়ার দিয়ে। তবে এজেন্সির উচিত ক্লায়েন্টকে বাস্তবতা বোঝানো।’

পুরোনো কৌশল, নতুন মুখ: আগে খালেদা-সাঈদী, এখন ইউনূস

সামাজিকমাধ্যমে পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবি ও স্লোগান ব্যবহার করে লাইক বাড়ানোর এই কৌশল নতুন নয়। ডিসমিসল্যাবের আগের গবেষণায়ও এমন নজির পাওয়া গেছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে এক পেজ ‘খালেদা জিয়াকে জিতিয়ে দিতে চাইলে ডান পাশে লাইক দিন’— এই ক্যাপশন দিয়ে একটি বিজ্ঞাপন চালায়। সেখানে কোনো ডিসক্লেইমার ছিল না বলে মেটা সেটি সরিয়ে দেয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে ‘মিল্টন সমদ্দার’ নামের একটি পেজ জামায়াত নেতা সাঈদীর ছবি ব্যবহার করে চালায় ভুয়া বিজ্ঞাপন—’আমি সাঈদী সাহেব, আমি আগামী সপ্তাহে মুক্তি পাচ্ছি। ডান পাশে ভোট দিন।’ মেটা সেটাও সরিয়ে দেয়।

এই পেজটি আরও ব্যবহার করে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোরসি, পাকিস্তানের ইমরান খান ও মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের ছবি। লক্ষ্য একটাই– লাইক ও জনপ্রিয়তা বাড়ানো।

এ এম ফারুক বলেন, ‘আগেও এসব হয়েছে। এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস জনপ্রিয়, তাই তাকেই ব্যবহার করছে।’

  



মেটার নীতিমালার ঘাটতি, বাংলা বিজ্ঞাপন শনাক্তে দুর্বলতা

মেটার নীতিমালা অনুযায়ী, রাজনৈতিক বা সামাজিক ইস্যুভিত্তিক বিজ্ঞাপনে অর্থদাতার নাম ও যাচাইকৃত তথ্যসহ ‘পেইড ফর বাই’ ডিসক্লেইমার থাকতে হবে। এসব বিজ্ঞাপন অ্যাড লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত থাকে, যাতে তথ্য স্বচ্ছ থাকে।

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে চালানো ৫৫টি বিজ্ঞাপনের একটিতেও কোনো ডিসক্লেইমার ছিল না। এর মধ্যে ৪৩টি বিজ্ঞাপন অনুসন্ধান চলাকালীন সক্রিয় ছিল, ১২টি সরিয়ে ফেলা হয়। সাতটি বিজ্ঞাপনে একই ছবি ব্যবহার করা হয়– ঈদের নামাজ শেষে ড. ইউনূস সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন।

‘জোবাইদাস ভ্লগ ইউএসএ’ পেজ থেকে চালানো তিনটি বিজ্ঞাপনের মধ্যে মেটা দুটি সরালেও একটি বিজ্ঞাপন মে মাস পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। বিষয়টি ফেসবুকের অ্যালগরিদম ভিত্তিক নজরদারির সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলা ভাষায় লেখা পরোক্ষ স্লোগান ভিত্তিক বিজ্ঞাপনগুলো শনাক্ত করতে মেটার বর্তমান ব্যবস্থায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামান বলেন, ‘যাকে প্রচার করা হচ্ছে এবং যেভাবে করা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অবশ্যই রাজনৈতিক বিষয়ে পড়ে।’

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া

ডিসমিসল্যাব এই অনুসন্ধান পরিচালনা করেছে ২০২৫ সালের ১৫ মে থেকে ১৮ মে পর্যন্ত। তারা মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে তিনটি বাংলা কীওয়ার্ড— ‘ইউনূস’, ‘ইউনুস’ (বিকল্প বানান), এবং ‘৫ বছর’ ব্যবহার করে ৫৫টি বিজ্ঞাপন শনাক্ত করে, যা ৪৭টি পেজ থেকে চালানো হয়েছে।

প্রতিটি পেজের সর্বশেষ ২০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, পেজটি পূর্বে কোনো রাজনৈতিক কনটেন্ট শেয়ার করেছে কিনা। পেজগুলোকে শ্রেণিবিন্যাস করা হয় ব্যবসা, মিডিয়া, ভ্লগ বা রাজনৈতিক ক্যাটাগরিতে।

ছয়জন অ্যাডমিনের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানার চেষ্টা করা হয়, কেন তারা এমন বিজ্ঞাপন চালিয়েছেন। বং কী ধরনের বিজ্ঞাপন কৌশল ব্যবহার করেছেন, সেটাও জানার চেষ্টা করা হয়।

যেসব পেজের নাম বা অ্যাডমিনের বক্তব্য আগে থেকেই প্রচারিত বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত, শুধুমাত্র সেই তথ্যগুলো প্রকাশ করা হয়েছে; অন্যদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।

এবং সবশেষে, এসব তথ্য মেটার বিদ্যমান বিজ্ঞাপন নীতিমালার সঙ্গে তুলনা করে মূল্যায়ন করা হয়েছে।


Post a Comment

0 Comments